top of page

মানুষের মানুষটি

মানুষটির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ চলন্ত রেলগাড়ির কামরায়। তার আগেই যদিও সুহৃদ ভ্রাতৃসম বন্ধু ঝিলমের কাছে শুনে শুনে মানুষটি সম্বন্ধে একটা কায়াকল্প তৈরি হয়েছিল মনের মধ্যে। সামনাসামনি দেখে আমার ধারণার সঙ্গে খুব বেশি তফাৎ খুঁজে পাইনি। তবে হঠাৎ করে আমার খুব প্রিয় স্রষ্টা সলিল চৌধুরীর সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম যে এই মানুষটিও সলিলের মতনই একটি প্রিজম্‌ - যার ভেতর দিয়ে আলো এসে নানান রঙে ছড়িয়ে পড়ে নানান আঙ্গিনায়।


খুব অল্প কয়েকদিনই ওনাকে চেনার-জানার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাও খুব বিক্ষিপ্তভাবে। দুটি দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। মালদহ গিয়েছিলাম এক সমীক্ষার কাজে - ঝিলম ও আমি। সপরিবারে গিয়েছিলাম, কাজের শেষে ক্ষণিক অবসর যাপনের উদ্দেশ্যে। যেদিন পুরনো ‘গৌড়’ আর বাংলাদেশ সীমান্ত দেখতে যাওয়া হল সেদিন সারাদিন আমাদের সঙ্গ দিলেন মানুষটি। নীরব, ভগ্ন সৌধ বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল উনার সচল, সরস অথচ জ্ঞানগম্ভীর বিবরণীতে। তিন নাতি-নাতনীকে নিয়ে দাখিল-দরওয়াজার অনেক খিলানগুলির একটি-তে বসে পুষ্পজিৎবাবু গল্প করছেন - তাদের মতন করে, তাদের মধ্যে মিশে গিয়ে, এ দৃশ্য এখনও আমার চোখে ভাসছে।


এর প্রায় দু'বছর পর হঠাৎ কয়েক ঘণ্টার জন্য মালদহ গেছি সরকারি কাজে। সকালে গিয়ে উঠলাম ওনার বাড়ি। সেদিন ঘণ্টা দুয়েকের কাজ ছাড়া রাত্রে রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে পর্যন্ত্য প্রায় সারাটা দিন অনেক গল্প আড্ডা হয়েছিল উনার সাথে। খুব আপন মনে হয়েছিল সেদিন মানুষটাকে। প্রচুর মিল খুঁজে পেয়েছিলাম আজীবন কমিউনিস্ট মানুষটির সঙ্গে আমৃত্যু কংগ্রেসী আমার বাবার। দুই বিপরীত দিক থেকে দুজনেরই অভীষ্ট লক্ষ্য এক - সাম্য আর গণদেবতার উন্নতি। শুধু দুজনার পথ আলাদা - যেন ‘নর্থ কল’ আর ‘সাউথ কল’ থেকে ‘মাউন্ট এভারেস্টে’ ওঠার প্রচেষ্টা। কিন্তু সে প্রচেষ্টা আর বিশ্বাসের প্রতি ভালবাসা, ভরসা-টুকু দুজনের-ই নিখাদ।


বহুমুখী মানুষটি সারা জীবনে অনেক কিছু করেছেন। তার উল্লেখ বা মূল্যায়ন কোন কিছু করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে যেটুকু বুঝেছি, যা কিছু করেছেন, এমনকি লেখালেখিও, তার কেন্দ্রে ছিল মানুষ। আরো পরিস্কার করে বললে ব্যক্তি মানুষ বা একাকী স্বতন্ত্র মানুষ নয়, গোষ্ঠীবদ্ধ, সমষ্টিগত মানুষ। যাকে আমরা সমাজ বলে থাকি। সারাটা জীবন নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন মানুষকে তার আমিত্ব-র কুঠুরি থেকে বের করে এনে সবাকার মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেবার। একের দুর্বলতাকে বহুর সবলতায় পাল্টে দেবার। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকে গণনাট্য, দলীয় সংগঠন থেকে লোক-সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসার, কবিতা লেখা থেকে পত্রিকার সম্পাদনা, সমস্ত কাজেরই মূল বীজটি ছিল সমাজকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়ার তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষা। যদি তাঁর নামের অন্য রূপটিকে (পুষ্পজিত) নেওয়া যায়, তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তাঁর নামকরন সফল হয়েছিল – নিজের মধ্যে সুপ্ত অগণিত ইচ্ছা ও প্রচেষ্টার অঙ্কুরকে প্রস্ফুটিত করতে পেরেছিলেন, নিজেকে জাহির না করেই।


যখন তাঁকে আমি দেখেছি তখন তাঁর নামের প্রথম অংশটির মতনই কোমল মৃদুভাষী দেখেছি তাঁকে। যদিও ভেতরের দৃঢ়তাটুকু বোঝা যেত মতামতের বলিষ্ঠতা আর বিশ্বাসের স্থিরতায়। তাঁর নিজের কাছের লোকজনের মুখে শোনা বা তাঁর লেখার মধ্যে থাকা অনুকাহিনীগুলো পড়ে উপলব্ধি করেছি আপাতঃ নরম মানুষটির মধ্যে লুকিয়ে আছে ইস্পাতকঠিন আরেকটি মানুষ, যিনি ঝুঁকতে জানেন না। বেশ কিছু বছর থেকেই হৃদযন্ত্র প্রায় অর্ধেক কাজ করছিল না। ভাবতাম আধখানা হৃদয় নিয়েই চারপাশের অগণিত মানুষকে এত ভালবাসতে পারেন যিনি, তাঁর হৃদয় আসলে কত বড়ো! নত না হওয়া মানুষটি চলে গেলেন মাথা উঁচু করেই - কারোর কাছে বিন্দুমাত্র কোনো দায়ের ঋণ না রেখে। তাঁর ভাষা ধার করে বলি – বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা যার হৃদয়, ওই লাল পতাকার তারাটির মতন স্থির লক্ষ্যে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন তিনি, এই ভরসাটুকুই আমাদের পাথেয়

تعليقات


bottom of page