top of page

বিশাল কর্মকাণ্ডের বিরল নীরব হোতা ...

Updated: Jul 6, 2021


মালদা, ৬ মে: এবার করোনা প্রাণ কেড়ে নিল মালদা জেলার বিশিষ্ট কবি তথা মালদা কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. পুষ্পজিৎ রায়কে । মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। সম্প্রতি তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে বেসরকারি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই জেলার শিল্পী, সাহিত্যিকমহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।


প্রসঙ্গত, গত ২৬ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিকাশ রায়ের। এর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে গত ৪মে করোনা কেড়ে নেয় প্রবীণ কবি হরিচরণ সরকার মণ্ডলকে। তিনি ছিলেন ভিটেমাটি সাহিত্য পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। এরপর বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝড়ে গেল আরও একটি প্রাণ।


পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৪২ সালে ওপার বাংলার দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে জন্ম পুষ্পজিৎবাবুর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেন। এরপর মালদা কলেজে শুরু করেন অধ্যাপনা। শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য ভূমিকা ছিল। তার উদ্যোগে জেলায় গড়ে ওঠে সবুজ অবুঝ শিশু অঙ্গন নামের একটি নার্সারি স্কুল। দৃষ্টিনন্দন হাতের লেখা ছিল পুষ্পজিৎবাবুর। জেলার সাহিত্য, সাংস্কৃতিকমূলক সংগঠনের কাছেও তিনি ছিলেন পথিকৃত। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ এবং পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘের পরিচালনার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন. নানা সময়ে তাঁর কাজের জন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আম্বেদকর সম্মান লাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমির পক্ষে লিটল ম্যাগাজিনের সফল সম্পাদক হিসেবে সংবর্ধিত হন। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হত জোয়ার সাহিত্য পত্রিকা।


বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে শোক প্রকাশ করেন জেলার বিশিষ্টজনেরা। মালদা কলেজের অধ্যাপিকা দীপাঞ্জনা শর্মার কথায়, ‘চাকরিসূত্রে মালদায় আসার আগে থেকেই তাঁর লেখা গম্ভীরা বিষয়ক প্রামাণ্য বইটির সূত্রে তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিতি। আলাপের পর আন্তরিকতার উষ্ণতা টের পেতে বেশী সময় লাগেনি। সুবক্তারা সাধারণত মনোযোগী শ্রোতা হন না, পুষ্পজিৎবাবু দুটোই ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের আলো ছিল, তাপ ছিল না। ফলে আমার মত অর্বাচীনও তাঁর সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। গল্প-উপন্যাসে পড়া ধুতি-পাঞ্জাবির বাংলা অধ্যাপকের শেষ দলের প্রতিনিধি হিসেবে তার হাস্যময়, সৌম্য চেহারাটা আজ চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে।‘


জেলার বিশিষ্ট লেখিকা তৃপ্তি সান্ত্রার কথায়, ‘কালকেও বৌদি জানিয়েছেন, স্যার ভালো আছেন বই পড়তে চেয়েছেন। বই। লেখা। চিঠি. পত্রিকা। রিপোর্ট। চিরকুট। চিঠি। প্রতিবেদন। সাহিত্য। লোকসাহিত্য। আমরা সব কিছুর স্বাদ পেয়েছি তাঁর বইঘরে। ফেসবুকের জগৎ নয় তখন, জ্ঞানচর্চা সহজ ছিল না। বরিন্দর হেটো-মেঠো-সদর সবার জন্য দ্বার খোলা ছিল স্যারের।



হ্যাঁ। স্যার। সেই কলেজ জীবন থেকে আজ অবধি, সময় পরিবর্তনের নানা ঢেউয়ে যুক্তিগ্লপ্পো-তর্কপ্রিয়তায় আপনার কাছে আমরা হাজির হয়েছি বিভিন্ন স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে। ফেরাননি। আজ এই শহর হারালো শুধু বইঘর নয়, রামকৃষ্ণপল্লির সহজ উঠোন নয়, লোকসাহিত্যের এক তন্নিষ্ঠ সাধককে। অপূরণীয় ক্ষতি।’


নাট্যকার তথা অধ্যাপিকা অনুরাধা কুন্ডার কথায়, ‘এখন কোনও মৃত্যু আর আহত করছে না। এতটাই পাথর হয়ে গেছি। এতটাই স্তব্ধ। অপ্রস্তুত। ফোনে কণ্ঠ পাবো না আর কখনও। দেখা হলে মিতবাক মানুষটি স্নেহের হাসি হেসে বোসো, বলবেন না। স্যার পুষ্পজিৎ বাবু। কতবার কতো অনুষ্ঠানে যে আপনার উপস্থিতির আশীর্বাদ পেয়েছি। সাহিত্য অনুষ্ঠান ডেকেছেন। গল্প পড়বে। শেষে গান কোরো একটা, এইসব খুব ব্যক্তিগত। এখন নৈব্যক্তিক হতে পারছি না। অধ্যাপক। প্রাবন্ধিক। কবি। সংগঠক। এইসব পরিচয় নিয়ে অনেকে লিখবেন। আমি শ্রদ্ধা জানাই তাঁর পরিমার্জিত ব্যক্তিত্বকে। সূক্ষ্ম রসবোধ। দূরদর্শী আচরণ। নাটক দেখতে এসেছেন। পাশে স্বপ্নাদির শান্ত উপস্থিতি। বেশি কথা বলতেন না। যেটুকু বলতেন তার মধ্যে সবটুকুই সারবস্তু। বড় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। আপনি গভীর শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন স্যার।


এই ছোট শহরে ও ব্যক্তিগত তৈলমর্দন ছাড়া মঞ্চ বা লিখন পরিসর পাওয়া মুশকিল। সেটা যারা পারেনা তাঁরা জানেন আপনি কেমন করে গল্পের আসর তৈরি করে জায়গা দিতেন সবাইকে। সেই বিরল অথচ বিশাল কর্মকাণ্ডের নীরব কর্মী ও হোতাকে আমার প্রণাম জানাই।'

Kommentare


bottom of page