মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে ...
মালদায় তখন আমার পরিচিতি খুবই কম। আমার বড় ছেলে সবুজ অবুঝ স্কুলে পড়ে (পরে আমার ছোট ছেলেও পড়েছে)। ওর কাছে স্যরের কথা শুনতাম। উনি যেন অন্য গ্রহের মানুষ। হঠাৎ হঠাৎ শিশুদের মাঝে আসতেন, দেখতেন আর জয় করে নিতেন ওদের মনপ্রাণ।
অনেক পরে এই স্বল্পভাষী, দূর-থেকে-মনে-হওয়া রাশভারী মানুষটির সাহচর্যে এলাম। জানলাম, উনি দু'এক জায়গায় আমার ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আলোচনা শুনেছেন। ভাল লাগল যখন এই মানুষটি আমাকে তাঁর কাজের সঙ্গী করে নিলেন। বহু জায়গায় আমাকে বলার সুযোগ করে দিলেন। ওঁর ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করলাম। শহরে গ্রামে কত জায়গায় না গেছি। অনেকবারই বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অভিজিৎ সেন সঙ্গে ছিলেন।
প্রত্যেকটি আলোচনা সভা ছিল সুসজ্জিত, সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল। পরিচালনায় সংগঠনের যাদুকর পুষ্পজিৎ রায়। শুরুতে দু'চার কথায় বিষয়টি সবার সামনে হাজির করবেন ও বক্তাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন। পরিশেষে নিজস্ব কুশলী পদ্ধতিতে ও পরিচ্ছন্ন ভাষায় সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনার সারাংশটুকু তুলে ধরবেন। ছোটবেলায় কবি Swinburne সম্বন্ধে Stopford A. Brooke - এর History of English literature- এ একটি মন্তব্য যেন ওঁর সম্বন্ধে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। মনে হয় ""He never expatiates; he knows how to compress."
জীবনে নানা কাজ করেছেন। নিজেকে অধ্যাপনা ও সাহিত্যচৰ্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের সচেতনতা জাগরণে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। সব কাজেই তিনি বরেণ্য, অগ্রগণ্য। তাঁর শুভভাবনায় ও কর্মে কখনো কখনো সঙ্গে থাকতে পেরে আমরা ধন্য। কেবল দিয়েছেন, প্রতিদান কিছু চাননি। যশ, প্রতিষ্ঠা, পদ, ক্ষমতা - কোনোকিছুরই প্রতি ভ্রূক্ষেপ ছিল না। অন্তরালে থেকে মননে, চিন্তায়, প্রত্যয়ে, কর্মে, দৃঢ় থেকেছেন।
এই মানুষটির মধ্যে দেখেছি সংযম, স্থৈর্য ও পরিমিতিবোধ। প্রচারবিমুখ, বাক-সংযমী মানুষটি অনেক সময় নীরব শ্রোতা হয়ে অন্যের বাক-স্বাধীনতাকে প্রশ্রয় দিতেন।
একবার তাঁকে বক্তব্য উপস্থাপনার শেষে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আবৃত্তি করতে শুনেছি - সংযত অথচ উদাত্ত কন্ঠে। সেদিন মনে হল কবিতা ও আবৃত্তিকার মিলেমিশে একাকার। মুহূর্তে 'ভাবোন্মত্ততায় বিহ্বল' নন। 'উদভ্রান্ত' নন। 'শান্তিরস, স্নিগ্ধ সুধাপূর্ণ' তাঁর 'মঙ্গলকলস'। 'নিগুঢ় গভীর' জীবন তাঁর। 'শুভচেষ্টায়, আনন্দে, কল্যাণে' সফল হওয়ার তীব্র আকুতি তাঁর। সেদিনের সেই আবৃত্তি এক বিরল অভিজ্ঞতা। কবিতাটি - 'অপ্রমত্ত':
যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য নাহি মানে,
মুহূর্তে বিহ্বল হয় নৃত্যগীতগানে
ভাবোন্মাদ-মত্ততায়, সেই জ্ঞানহারা
উদ্ভ্রান্ত উচ্ছল-ফেন ভক্তি-মদধারা
নাহি চাহি নাথ।
দাও ভক্তি শান্তিরস,
স্নিগ্ধ সুধা পূর্ণ করি মঙ্গল কলস
সংসার-ভবন-দ্বারে। যে ভক্তি-অমৃত
সমস্ত জীবনে মোর হইবে বিস্তৃত
নিগূঢ় গভীর,— সর্ব কর্মে দিবে বল,
ব্যর্থ শুভ চেষ্টারেও করিবে সফল
আনন্দে কল্যাণে। সর্বপ্রেমে দিবে তৃপ্তি,
সর্ব দুঃখে দিবে ক্ষেম, সর্ব সুখে দীপ্তি
দাহহীন।
সম্বরিয়া ভাব-অশ্রুনীর
চিত্ত রবে পরিপূর্ণ অমত্ত গম্ভীর।
Comentarios