ইশকুলের নাম সবুজ অবুঝ শিশু অঙ্গন। ইশকুলের ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞাসু, চঞ্চল, ছটফটে। কিন্তু, সেই জিজ্ঞাসাদের, সেই অগুণতি বলতে চাওয়াকে কেউ আটকে দেয়না। সবুজ শৈশবের যাবতীয় অবুঝ আবদারকে লালন করা হয় সেই ইশকুলবাড়িতে। প্রতিদিনের ক্লাসঘরে, খেলার মাঠে, বুড়ো রবার গাছের আড়ালে, বাতাবিলেবুর গাছে শৃঙ্খলা আর মুক্তির যুগপৎ পাঠ দেওয়া হয়।বাঁধনের হাত ধরেই অজস্র শৈশব সেখানে আকাশে ডানা মেলার স্বপ্ন দেখতে শেখে।
ইশকুলে লেখাপড়া হয়। অথচ, কেউ জানেনা ক্লাসের প্রথম হওয়া ছাত্রের নাম। কেউ খোঁজও নেয়না। বদলে কী হয়? পরের ক্লাসে ওঠার একটা লম্বা বাদামি কাগজের খামে সকলের জন্যে থাকে রেজাল্টের কাগজ।আর সঙ্গে থাকে ক্লাসের সকলের জন্য নতুন একটা বই।
ইশকুলে লেখাপড়া হয়। অথচ, সরস্বতীপুজো হয়না। ছোট্ট শিশুরা শেখে বিদ্যার উৎস দেবীমূর্তিতে নেই, আছে বইয়ের পাতায়, আছে ক্লাসের বেঞ্চে, আছে বন্ধুর সঙ্গে খেলাধুলোয়। পুজো হয়না এ'কথা যেমন ঠিক, তেমনই আনন্দের অন্যতর নির্মিতিও একেবারে হাতেকলমে হয়। কীরকম? সরস্বতী পুজোর আগে-পরে তিনটে দিন ইশকুল জুড়ে হইহই কান্ড। সব ছেলেমেয়েরা নেমে পড়েছে মাটি দিয়ে, কাগজ দিয়ে, কাপড় দিয়ে, তুলো দিয়ে নানারকম হাতের কাজ করতে।যার যেমন মন চায়, যে যেমন পারে তেমনটাই সে অমিত উৎসাহের সঙ্গে করবে। আর এইসবটাই থাকবে ছাত্রদের নিজেদের হাতে সাজানো প্রদর্শনীতে। সঙ্গে থাকবে বইমেলা, থাকবে সকলের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ' প্রদর্শনী বা অনুষ্ঠান শিল্পকলাগত গুণমানে খুব এগোতে পারবে না হয়তো, কিন্তু পৃথিবীতে যৌথতার শ্রেষ্ঠতম উদযাপনগুলোর মধ্যে এটা থেকে যাবে। ইশকুলটা শুধু সরস্বতী পুজো না করেই আটকে থাকেনি, ছড়িয়ে দিয়েছে বিকল্প পথের ইশতেহার। কেবল ভাঙা নয়, বিপুল এক গড়াও চলেছে সমান্তরালে।
একটা ছোটদের ইশকুল। সেখানে সারাবছরে একটা খেলাধুলার আসর বসে। সেখানে নেই কোন বাছবিচার। ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা খেলবে একই খেলা। খেলতে হবে সব্বাইকে। এবং উপহার আবারও বই। বই ছাড়া আর কখনো ছাত্রদের দ্বিতীয় কোন উপহার এ ইশকুল দেয়না। ক্লাসের একজন ছাত্রেরও মজার আসর বা খেলাধুলার আসর থেকে বাদ পড়ে যাবার অবকাশ নেই। সবাই মানে আক্ষরিক অর্থেই সবাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
যে সময়ে ইশকুল যেতে হত বড় হয়ে ভাল চাকরি করার ইচ্ছে নিয়ে, সে' সময় শিশু অঙ্গনে শিশুরা যেত নদীমাঠবনকে ভালবাসার পাঠ নিতে। ইশকুলে যেত মনের দরজা খুলতে শেখার জন্য।ইশকুলে যেত বন্ধুর হাত ধরতে শেখার জন্য। ইশকুলে যেত আনন্দ ভাগ করার আনন্দটুকু পাওয়ার জন্য।
কোন চিৎকৃত বিজ্ঞাপন নেই। কোন বাণিজ্যিক প্রচার নেই। আছে প্রশ্ন করতে শেখানো, দ্বিমত হতে শেখানো। আছে প্রতিপক্ষকে সম্মান করতে শেখা আর শেখানো। আছে উল্টোদিকের মানুষকে স্বীকৃতি দিতে শেখানো।
বিচ্ছিন্নতার দশকে, একলা বাঁচার জনপ্রিয় আবহে যে ইশকুল বলে 'সবার সাথে শিখতে শেখা'র কথা,জীবনের সমস্ত পথে সেই ইশকুলই যোগাবে আমায় আমার বুনিয়াদি পাথেয়।
এই ব্যতিক্রমী শিক্ষাঙ্গনের কান্ডারী দুজন মানুষ। আমাদের বড়দিদিভাই শ্রীমতী স্বপ্না রায়।আমাদের মাস্টারমশাই শ্রী পুষ্পজিৎ রায়। মাস্টারমশাই আজ চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
গতকাল মার্ক্সের ২০৪ তম জন্মদিন পেরিয়ে এসেছি।মাস্টারমশাইরাই রোজ দেখিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে মার্ক্সকে বইয়ের পাতার বাইরে জীবনের মাঠে প্রয়োগ করতে হয়। আজীবন বামপন্থী বীক্ষণের শরিক এই মানুষটি তাঁর সারাজীবনের কাজ দিয়ে মার্ক্সীয় দর্শনকে প্রায়োগিক সার্থকতা দিয়ে গেলেন। তাঁর গড়ে তোলা ইশকুল সারাজীবন, নিরন্তর ছড়িয়ে যাবে এই অনন্য ভালোবাসার ইথার।
"ভালোবাসি রোদজল,আলোর কিরণ,
ভালোবাসি নীলাকাশ নদীমাঠবন।
ভালোবাসি ফুলগান,অমল জীবন,
ভালোবাসি আমাদের শিশু অঙ্গন।"
এই লাইনচারটি ছিল আমার শৈশবের মেঘদূত। মেঘদূতের স্রষ্টার আজ চিরবিদায়। যাবার সময়, আমার মাস্টারমশাইকে দেওয়ার মত একটিই উচ্চারণই আমার কাছে রয়েছে ...
"শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড,
এসো মোরা মিলি একসাথ,
গাও ইন্টারন্যাশনাল,
মিলাবে মানবজাত।"
মাস্টারমশাই এর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা এবং অন্তরের প্রণতি রইল।
(ছবিটা সাজিয়ে দিয়েছে বিতান। ওকে অনেক ভালোবাসা।)
Comments