গত ৬ মার্চ ২০২১ আমরা হারিয়েছি আমাদের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. পুষ্পজিৎ রায় মহাশয়কে।
'পুষ্পজিৎ রায়' ...
খুব ছোটোবেলা থেকে এই নামটির সঙ্গে ছিলাম পরিচিত। আমি যখন স্কুলে পড়ি মালদা টাউন হলে কোনো এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় উনি বক্তব্য রাখছিলেন — কীভাবে বড়রা বাচ্চাদের শুদ্ধ উচ্চারণ শিখাতে পারে ... আমার শোনা ওনার প্রথম বক্তৃতা। মুগ্ধ হয়েছিলাম। এরপর বহু সভায় ওনাকে দেখেছি।
আমরা ছিলাম গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচ। তখনও আমাদের স্যার-ম্যাডামেরা সকলে যোগদান করেননি। পড়াতেন কেবল সৌরেন স্যার। সকাল ৭-টায় ক্লাস হতো। উনি আমাদের ক্লাস নিতেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়াতেন। সেই ওনাকে প্রথম শিক্ষক হিসেবে পেলাম। একদিন ক্লাসে কিছু পড়ালেন না। জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন কোন সাহিত্য পত্রপত্রিকার নাম জানি আমরা। জেলা থেকে প্রকাশিত কোনো পত্রিকার নাম জানি কি না। — 'জেলার সাহিত্যিকদের নাম জানো?'
কিছুই জানতাম না। লজ্জা পেয়েছিলাম।
আজ এতোদিন পর মনে হয় কেবল — এই যে আমি মালদা জেলার নাটকের ইতিহাস নিয়ে কাজ করলাম এই ইন্ধন জুগিয়েছিলেন তিনিই। সেই ক্লাসে।
গবেষণার কাজে উনি আমায় নানা সূত্র দিয়েছিলেন।
আমাকে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য করে ওনার জোয়ার পত্রিকা প্রকাশ। জেলায় বসে প্রায় ৪৯খানা সংখ্যা প্রকাশ করেছেন! আমরা যারা সবে পত্রিকা প্রকাশের কাজে এসেছি জানি একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশে কত লড়াই করতে হয়।
স্যার ছিলেন লোকসংস্কৃতি গবেষক — 'গম্ভীরা', 'মুখোশের কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ সংকলন', 'মালদা জেলার লোকসংস্কৃতি', 'মালদহ জেলার লৌকিক ছড়া ও সংগীত' এই গ্রন্থগুলির ছিলেন রচয়িতা।
স্যার ছিলেন একজন বড় সংগঠক। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের মালদা জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। মন্মথ রায়ের সাঁওতাল বিদ্রোহ নাটকে অভিনয় করতেন। বাস্তব শাস্ত্র নাটকে অভিনয় করতেন রাজনৈতিক নেতার ভূমিকায়।
আমরা যারা মালদাবাসী, জানি ১৯৮৩-এর ৫ জুলাই রতুয়া থানার মালোপাড়ায় সেই নারকীয় গণহত্যার ঘটনা। স্যারের মানবিক হৃদয় মালোপাড়ার অত্যাচারীত সেই পরিবারগুলির পাশে দাঁড়িয়েছিল। মালদাবাসীর নিকট তাদের সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন স্যার। এইভাবেই তাঁর সাহিত্যচর্চায় আমরা বারবার খুঁজে পাই ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, লড়াইয়ের ছবি ...
যেমন —
ভিটেমাটি ছিল, আছে তবুও স্বদেশ
কেন আমি উৎখাত খোঁজ নিয়ে জেনো,
অপরাধী নই আমি তবুও স্বদেশ
পাড়া ছাড়ো! ভেগে যাও! এ জুলুম কেন?
এ জুলুম সইব না বেশি দিন আর
মোকাবিলা করে, যাবো ভিটেয় আবার। [ভিটেমাটির কথা]
বা
কানকাটা রাজা হে
জান রাখা দায়।
স্যাঙাতেরা রোজ রোজ
চায় খালি হেবি ডোজ
না পেলেই খেয়োখেয়ি
কেবা সামলায়।
কজনারে ঝোলাবে হে
মিসা মামলায়।
কানকাটা রাজা হে
জান রাখা দায়।
পুষ্পজিৎ রায়ের সাহিত্য তাই এই সংকটকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। আমাদের শক্তি যোগায়।
স্যার যেভাবে আমাদের মতো তরুণ গবেষেক সাহিত্যিকদের পাশে থাকতেন, উৎসাহ দিয়ে যেতেন ...
আমাদের উচিত তাঁর সাহিত্য আরও বেশি করে চর্চা করা। বাঁচিয়ে রাখা। তবেই আমরা স্যারকে যোগ্য সম্মান জানাতে পারব। এই চর্চার দ্বারাই ওনাকে স্মরণ করে যাব আমরা ...
ধন্যবাদ
Comments